আতঙ্কে তিন লাখ বাড়িওয়ালা


বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসায় হাইকোর্টের পক্ষ থেকে কমিশন গঠনের নির্দেশনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে রাজধানী ঢাকার তিন লাখ বাড়িওয়ালার মাঝে। তাদের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য ক্ষুণœ হয়ে যাবে। অধিকার আদায়ের সুযোগ আসবে অসহায় ভাড়াটিয়াদের। যদিও কার্যকারিতা না থাকায় বাড়িভাড়া সংক্রান্ত চলমান আইন বাড়ির মালিকদের ওপর বিন্দুমাত্রও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে তিন লাখের মতো বাড়ি। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ নগরীর দুই কোটি বাসিন্দার মধ্যে প্রায় পৌনে দুই কোটিই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। বাকি ২৫ লাখ সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বসবাস করেন নিজ বাড়িতে। সংখ্যায় প্রায় সাত গুণ বেশি হলেও ভাড়াটিয়ারা এখানে বড়ই অসহায়। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের বসতি এলাকার বাড়িগুলোর মালিকেরা ভাড়াটিয়াদের সাথে আচরণ করেন অনেকটা আশ্রিতের মতো। যদিও এই ভাড়াটিয়াদের অর্থেই চলে বাড়িওয়ালাদের সংসার।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবস্থা আরো ভয়াবহ। সেখানকার বাড়িওয়ালারা ‘জমিদার’ হিসেবেই পরিচিত। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে, সরকারি কলোনিতে দুই কক্ষের বাসা বরাদ্দ পেয়ে যে কর্মচারী এক কক্ষ ভাড়া দিয়ে অন্য কক্ষে বাস করেন, তাকেও ‘জমিদার’ বলেই সম্বোধন করতে হয়। চলনে, বলনে, স্বভাব-চরিত্রে নিজেদের জমিদারি ভাবটা প্রকাশ করেন তারা হরহামেশাই। আর বেচারা ভাড়াটিয়া, তার অবস্থান অনেকটা অসহায় প্রজার মতো।বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে দেশে কড়া আইন আছে। ১৯৯১ সালের ওই আইনে ভাড়াটিয়ার স্বার্থ নানাভাবেই সুরক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে আইন কেবল কাগজেই সুরক্ষিত। বাস্তবে তার কোনো প্রভাব চোখে পড়ে না। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, কথায় কথায় ভাড়া বাড়ানো, সময় নির্দিষ্ট করে পানি দেয়া, নির্ধারিত সময়ের পরে বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া, ইচ্ছেমতো অগ্রিম আদায় করার মতো বেআইনি কাজ এখানে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের প্রতিনিয়তই শুনতে হচ্ছে, ‘ভালো লাগলে থাকেন, না লাগলে বাড়ি ছেড়ে দেন।’বাড়িওয়ালার নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া আক্তার গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ছোট্ট একটা রুম। চৌকি দেয়ার পর এক হাত জায়গাও খালি নেই। ৩৪টা পরিবারের রান্না করতে হয় দুইটা চুলায়। নারী-পুরুষ সবার গোসলের জন্য খোলা একটা জায়গা। অথচ মাস গেলেই আড়াই হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। দুই মাসের অ্যাডভান্স দিতে হয়। কোনো কারণে ভাড়া দিতে এক দিন দেরি হলে অকথ্য গালিগালাজ। এতকিছুর সাথে যুক্ত হয় বাড়িওয়ালা ও তার ছেলেদের নানারূপ যৌন হয়রানি। রোকেয়ার মন্তব্য, ‘টাকা দিয়েও মান-ইজ্জত নিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই।’
কিছুটা অন্যরকম হলেও বাড়িয়ালা কর্তৃক নির্যাতিত হন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারাও। খিলগাঁও সি ব্লকের বাসিন্দা রকিবুল হক এ প্রসঙ্গে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বারবার চেয়েও বাড়িওয়ালার কাছ থেকে কোনো চুক্তিনামা নিতে পারিনি। চার বছরে প্রায় আট লাখ টাকা ভাড়া দিয়েছি কিন্তু কোনো রশিদ পাইনি। বছর শেষ না হতেই ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে কেবল জানিয়ে দেন, আমার মতামতের কোনো তোয়াক্কাই করেন না। একটু জোরে শব্দ হলে দৌড়ে এসে কলিং বেল টেপেন। ক’দিন পরপরই কাজের লোক পাঠিয়ে খবর নেন, পানির কল খোলা আছে কি না? রাত ১১টার পর গেট বন্ধ করে দেন, কোনো সমস্যাই শুনতে চান না। কথায় কথায় ফরমান জারি করেন, ‘আমার বাড়িতে আমি যা চাই তা-ই হবে।’ যদিও ভাড়াটিয়া হয়ে বাড়িতে ঢুকে মালিককে বের করে দিয়ে পুরো বাড়ি দখল করে নেয়ার উদাহরণও এ দেশে আছে।
এভাবে ভাড়া দিতে বিলম্ব হলে বাসায় তালা লাগিয়ে দেয়া, আতিথির সংখ্যা বেশি দেখলে নিষেধ করে দেয়া, বাসার নিত্য ব্যবহার্য ফিটিংস ও কাচ ভাঙার দায়ে দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ আদায় করা, সময়ে-অসময়ে বাসায় এসে হয়রানি করা ভাড়াটিয়াদের নিত্যদিনই সইতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনজনদের সামনে অপমানিত হওয়ার ভয়ে কিংবা স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভাড়াটিয়াদের এসব নির্যাতন নীরবেই হজম করতে হয়। আর অপমান-অন্যায় সহ্য করতে না পেরে যারা ঘন ঘন বাড়ি বদল করেন তাদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা, পরিহন ব্যয় ও ভোগান্তি। স্বাভাবিক কারণেই এসব হতভাগার নিজের পাশাপাশি কমে যায় ফার্নিচারের আয়ুও।
বাড়িওয়ালাদের এমন অমানুষিক নির্যাতন এবং অন্যায় আচরণ থেকে ভাড়াটিয়াদের রক্ষার জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত বুধবার দেয়া বিচারপতি বজলুর রহমান ও বিচারপতি রুহুল কুদ্দুসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ আদেশে বলা হয়, গঠিত কমিশন মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধ নিষ্পত্তি ও বাড়িভাড়া নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে, সেই সাথে এলাকাভেদে গণশুনানি করে ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ ও বিরোধের বিষয়ে সুপারিশ করবে। আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইনজ্ঞসহ সাতজন সদস্য নিয়ে কমিশন গঠিত হবে। কমিশনে আরো থাকবেন নগর ও গৃহায়ন বিশেষজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, বাড়িভাড়া বিষয়ক এনজিওর একজন প্রতিনিধি, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মনোনীত সিটি করপোরেশনের একজন প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি।
হাইকোর্টের এই নির্দেশনায় নড়েচড়ে বসেছেন বাড়িওয়ালা। তাদের আশঙ্কা, কমিশন গঠিত হলে তাদের একচেটিয়া ক্ষমতায় কিছুটা হলেও চিড় ধরবে। ভাড়াটিয়াদের কথায় কথায় বাড়ি থেকে বের করে দেয়া যাবে না। যারা বছরে লাখ লাখ টাকা ভাড়া তুললেও সরকারকে কোনো আয়কর দেন না তাদের একটা জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। তবে এসবের মাধ্যমে বাড়িভাড়া আরো বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
Copyright 2011 দৈনিক সাতকানিয়া.
Blogger Template by Noct. Free Download Blogger Template